শাবান মাসে যেসব আমল বাড়িয়ে দিতেন নবীজি

চলছে শাবান মাস। হিজরি চান্দ্রবর্ষের অষ্টম এই মাসের পরেই আসছে মহিমান্বিত মাস রমজান। রমজানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবে শাবানকে ভালোভাবেই কাজে লাগাতেন প্রিয়নবীজি। অন্যদেরকেও বিশেষ আমলে উৎসাহিত করতেন। নিচে শাবান মাসে নবীজির আমলগুলো তুলে ধরা হলো।
১. রোজা রাখা
শাবানকে বলা হয় সর্বাধিক রোজা রাখার মাস। রাসুলুল্লাহ (স.) রমজান ছাড়া শাবান মাসে সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী কারিম (স.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা অন্যকোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প ক’দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন। (তিরমিজি: ৭৩৭)
শাবান মাসের রোজা খুব প্রিয় ছিল নবীজির। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (স.)-এর কাছে অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে রোজা রাখা অধিক প্রিয় ছিল। তিনি রমজান পর্যন্ত রোজা রাখতেন। (আবু দাউদ: ২০৭৬)
মূলত রমজানের আগের মাস হওয়ায় অনেকে শাবানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে না। সবার মধ্যে এর গুরুত্ব তৈরি করতে রাসুল (স.) সর্বাধিক রোজা রাখতেন এই মাসে। উসামা বিন জায়েদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞাসা করি, হে আল্লাহর রাসুল, শাবান মাসে আপনি যে পরিমাণ রোজা রাখেন, সেই পরিমাণ রোজা অন্য মাসে রাখতে দেখি না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, রমজান ও রজবের মধ্যবর্তী এ মাসের ব্যাপারে মানুষ উদাসীন থাকে। এটা এমন মাস, যে মাসে বান্দার আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই, আল্লাহর কাছে আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি রোজাদার। (সুনানে নাসায়ি: ২৩৫৭)
তাই শাবান মাসে অন্যান্য নেক আমলের পাশাপাশি সামর্থ্য অনুযায়ী রোজা রাখার চেষ্টা করা কর্তব্য। কিন্তু রোজা রাখবে শাবান মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত। হাদিসে রমজানের এক-দুই দিন আগে রোজা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। (দ্র. সহিহ বুখারি: ১৯১৪)
২. শবে বরাতে দীর্ঘসময় ইবাদত করা
শাবান মাসের ১৫তম রাতে ইবাদতের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। হজরত আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ ১৫ শাবানের রাতে অবতরণ করেন। অতঃপর সৃষ্টিজগতের সবাইকে ক্ষমা করেন। কেবল মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া। (ইবনে মাজাহ: ১৩৯০) অন্য হাদিসে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে ক্ষমা না করার কথাও এসেছে। এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফায়সালা করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘এই রাতে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ বিষয় ফায়সালা হয়।’ (সুরা দুখান: ৪)
আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইকরামা (রা.) বলেছেন, এ রাতে যাবতীয় রাতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জীবিতদের তালিকা করা হয় এবং হাজিদের নাম লেখা হয়। এরপর তাতে আর বাড়ানো হয় না এবং কমানো হয় না। (তাবারি: ২১/১০)
প্রিয়নবীজি শবে বরাতে দীর্ঘ সেজদার সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন। হজরত আলা ইবনুল হারিছ (রহ) থেকে বর্ণিত, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তখন ইরশাদ করলেন- هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان، فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم ‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি ৩/৩৮২-৩৮৩)
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যতটুকু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিস শরিফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (দ্র. ইকতিজাউস সিরাতিল মুসতাকিম ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ, পৃ. ২১৯)
৩. বেশি বেশি দান সাদকা ও কোরআন তেলাওয়াত
শাবান মাস শুরু হলে নবীজির দান-সদকা ও কোরআন তেলাওয়াতের পরিমাণ বেড়ে যেত। নবীজির দেখাদেখি সাহাবিরাও এসব নেক আমলে বিশেষ মনোযোগী হতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, প্রিয়নবীজির সাহাবায়ে কেরাম শাবান মাসের চাঁদ দেখলে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে পড়তেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যাঁদের ওপর জাকাত ফরজ হয়েছে, তাঁরা মালের জাকাত আদায় করে দিতেন। যাতে গরিব ও অসহায় মুসলমানদের রোজা রাখার ব্যবস্থা হয়ে যায়। বিচারকরা কয়েদিদের ডেকে শাস্তির হকদার হলে শাস্তি দিতেন, না হয় মুক্তি দিয়ে দিতেন। (লাতায়েফুল মায়ারেফ: ১/২২১)
৪. রমজানের মাসায়েল নিয়ে আলোচনা
রাসুলুল্লাহ (স.) ও সাহাবায়ে কেরাম শাবান মাসে রমজানের মাসয়ালা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করতেন। আমাদেরও বিষয়টি নিয়ে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। রমজানের রোজা যেহেতু বছরে একবার আসে সেহেতু তার বিধি-বিধানগুলো অনেকের কাছে স্মরণ নাও থাকতে পারে। তাই শাবান মাসে আমাদের করণীয় হলো, রমজানের বিধি-বিধান জেনে নেওয়া। যাতে রমজানের নিয়ামত আমাদের হাতছাড়া হয়ে না যায়।
৫. শাবানের প্রত্যেকটা দিন হিসাব রাখা
রমজানের প্রস্তুতির জন্য আরেকটি উত্তম কাজ হতে পারে শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা। মুসলমানদের জন্য চন্দ্রমাসের হিসাব রাখা ফরজে কেফায়া। অনেকেই তা রাখেন। তবে রমজানের আগমনের সঠিক হিসাব রাখার জন্য শাবান মাসের তারিখের হিসাব রাখা সুন্দর একটি আমল। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (স.) শাবান মাসের তারিখ এতটাই মনে রাখতেন, যতটা অন্য মাসের তারিখ মনে রাখতেন না। শাবানের ২৯ তারিখ চাঁদ দেখা গেলে পরের দিন রমজানের রোজা রাখতেন। আর সেই দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে শাবান ৩০তম দিন পূর্ণ করে রমজানের রোজা শুরু করতেন। (সুনানে আবু দাউদ: ২৩২৭)
৬. বরকতের দোয়া
রমজানের দুই মাস আগ থেকেই রাসুল (স.) একটি দোয়া বেশি বেশি পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রজব মাস শুরু হলে রাসুল (স.) দোয়া পাঠ করতেন— اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ (অর্থ) ‘হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। (বায়হাকি: ৩৫৩৪; নাসায়ি: ৬৫৯; মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শাবান মাসে নবীজির অনুসরণে যত সম্ভব নফল রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। দোয়া ও ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন